Magic Lanthon

               

কাওসার বকুল

প্রকাশিত ২৪ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

প্রেক্ষাগৃহের সেকাল-একাল

নির্মাতার মধ্যবিত্তের টান, বাড়ে হলছাড়া মানুষের ভিড়

কাওসার বকুল


শেষটা হয় প্রেক্ষাগৃহে

যৌগিক শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রকে যদি ভাগ করা হয়, তবে এর এক ভাগে নির্মাণ পড়লে অন্য অংশে পড়বে প্রদর্শন। পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী সবাই মিলে এতো এতো শ্রম দিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তার শেষ ঠেকে প্রেক্ষাগৃহে গিয়েই। এই প্রেক্ষাগৃহেই রচিত হয় চলচ্চিত্রের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা। চলচ্চিত্রের আসল উদ্দেশ্য যেহেতু দর্শকের কাছে যাওয়া, তাই দর্শকের কথা মাথায় রেখেই চলচ্চিত্রের কারিগরির সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রক্ষেপণের দিকেও খেয়াল রাখতে হয় সমানভাবে। অন্যথায় পরিচালকের এতো সাধের চলচ্চিত্রটি দর্শকের সামনে ধরা দেয় অঙ্গহানি নিয়ে।

যাই হোক, চলচ্চিত্র সম্পর্কে একেবারে শুরুর দিক থেকে বললে ফিরে যেতে হয় লুমিয়ের ভাইদের কাছে। ১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্রকে সবার সামনে প্রদর্শনের জন্য সিনেমাটোস্কোপ নামক যন্ত্র আবিষ্কার করেন তারাই। আবিষ্কারের পর পরই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তাদের কর্মচারীরা মাত্র পাঁচ কেজি ওজনের সিনেমাটোস্কোপ যন্ত্রটি ছড়িয়ে দেন বিশ্বব্যাপী। রাশিয়া, জার্মানির ধারাবাহিকতায় ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই তৎকালীন বোম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য আসেন লুমিয়ের ভাইয়েরা।

পরবর্তী সময়ে প্রদর্শনের উন্নতির জন্য একে একে আবিষ্কার হয়েছে নানা আধুনিক যন্ত্র; ১৬ মিলিমিটার, ৩৫ মিলিমিটারের গণ্ডি পেরিয়ে প্রদর্শনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এসে ঠেকেছে থ্রিডি আইম্যাক্স স্ক্রিন-এ। ৭২ ফুট দীর্ঘ ও ৯২ ফুট প্রস্থের এই আধুনিক প্রযুক্তির পর্দায় প্রদর্শন করা যায় সাধারণের চেয়ে অনেক বড়ো আকারের ও বেশি রেজ্যুলেশনের চলচ্চিত্র। পৃথিবীর বিভিন্নখানে যখন প্রদর্শন প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষ, ঠিক সেই সময়ে আমাদের এখানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একসময়ের গড়ে ওঠা অসংখ্য হাউজফুল প্রেক্ষাগৃহ। অথচ গত এক শতকে নানা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে এই প্রেক্ষাগৃহগুলো গড়ে উঠেছিলো। আজ তাহলে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ কিংবা ভেঙে ফেলা হচ্ছে কেনো? তাহলে কী ছিলো আমাদের অতীত, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান? প্রেক্ষাগৃহের এই অতীত-বর্তমান নিয়ে এই সময়ে তাই গভীর আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রদর্শনের ঐতিহাসিক পরিক্রমা

ফ্রান্সে চলচ্চিত্র আবিষ্কারের সংবাদে ব্যাপক কৌতূহলী হয়ে ওঠেন আমাদের এখানকার হীরালাল সেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তার প্রবল আগ্রহ ছিলো ফটোগ্রাফিতে। সে কারণেই নিজ উদ্যোগে তিনি বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) গিয়ে সাক্ষাৎ করেন লুমিয়েরদের সঙ্গে। সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে হীরালাল ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার ভোলায় এক পাটের গুদামে আয়োজন করেন চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। প্রদর্শনের জন্য বৃহদাকার অন্ধকার জায়গার প্রয়োজন ছিলোসে কারণেই হয়তো হীরালাল বেছে নিয়েছিলেন পাটের গুদামকে।

এই শুরু, গুদাম ছাড়িয়ে প্রদর্শনীর স্থান প্রসারিত হতে থাকে বাজার, স্কুল-কলেজের মাঠে নির্মিত প্যান্ডেলে। এছাড়া উচ্চবর্গের জন্য নবাব বাড়ির হলঘর, বিভিন্ন থিয়েটার হলে নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনও হতো। প্রদর্শন যেখানেই হোক না কেনো প্রত্যেক স্থানে দর্শক সমাগম হতো বিপুল সংখ্যক। বিপুল জনগোষ্ঠীর বিনোদন ক্ষুধা মিটাতে হীরালাল বিদেশ থেকে চলচ্চিত্র আমদানি করে এর প্রদর্শন করতে থাকেন। এজন্য তিনি একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি

পরবর্তী সময়ে আরো অনেকে এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সত্যচরণ ঘোষের বেঙ্গল বায়োস্কোপ, প্রমথ নাথের ওরিয়েন্টাল বায়োস্কোপ, অনীল চট্টোপাধ্যায়ের ইম্পারিয়াল, নারায়ণ বসাকের লন্ডন বায়োস্কোপ কোম্পানি ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের স্থায়ী ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করে। হীরালাল অবশ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত হননি; পাশাপাশি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রনির্মাতাও। নিতান্ত দায়সারাভাবে মাঝে মাঝে তার নাম উচ্চারিত হলেও এই গৌরবের স্বীকৃতি তাকে দেওয়া হয় না বললেই চলে।

যাই হোক, পূর্ব বাংলায় নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন হতো ১৯১৪ সাল থেকেই। ঢাকায় সর্বপ্রথম প্রেক্ষাগৃহ পিকচার হাউস নির্মাণ করা হয় এই সময়েই। এটি ছিলো ঢাকার আরমেনিয়ান স্ট্রিটে। জায়গাটি ছিলো মূলত নবাব ইউসুফ খান এস্টেটের গোরস্থান। পরবর্তী সময়ে এক ইংরেজ জমিটি কিনে বানান পাটের গুদাম; আরো পরে তিনি গুদামটিকে প্রমোদ হলে পরিণত করেন। এ সময় হলটিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে থিয়েটারকর্মীদের ভাড়া করে এনে নাটক করানো হতো। হিন্দি ও উর্দু নাটকের প্রাধান্য থাকলেও বাংলা নাটকও মঞ্চস্থ হতো। এই ইংরেজ ভদ্রলোক এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর স্থানটির দায়িত্বে আসেন উদ্দভজা ঠাকুর নামের এক মাড়োয়াড়ি। তিনি স্থাপনাটির নামকরণ করেন পিকচার হাউজ। এরপর ১৯২২২৩ সালের দিকে বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) ব্যানার্জি নামের এক ব্যক্তি পিকচার হাউজের মালিক হন। ১৯২৯ সালে এসে তিনি এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন পিকচার প্যালেস। এই পিকচার প্যালেসে চলচ্চিত্রের নিয়মিত প্রদর্শন শুরু হয় ১৯২৯ সাল থেকে।

১৯৪০ সালে রাজেন্দ্র কুমার গুহ ও মতিলাল বসু নামে দুজন প্রেক্ষাগৃহটি কিনে নাম দেন নিউ পিকচার হাউস। দীর্ঘদিন পর প্রেক্ষাগৃহটির মালিকানায় আবারও পরিবর্তন আসে। মোস্তফা নামে এক মুসলিম প্রেক্ষাগৃহটি কিনে ১৯৫৬ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন শাবিস্তান। সূচনালগ্ন থেকেই বিপুল সংখ্যক দর্শককে বিনোদন দিয়ে আসছিলো প্রেক্ষাগৃহটি। গ্রেটা গার্বো অভিনীত চলচ্চিত্র দিয়ে এর যাত্রা শুরু হলেও একে একে এখানে প্রদর্শন হয় অচ্ছুৎ কন্যা, ট্রেডার ইন, দ্য কিড, গ্যালপিং গেস্টসহ অসংখ্য চলচ্চিত্র। মালিকানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও দৃশ্যত কিছু পরিবর্তন আসে। আগে হিন্দি-উর্দু-ইংরেজি সব ধরনের চলচ্চিত্র প্রদর্শন হলেও এ সময় কিছুটা বাছবিচার লক্ষ করা যায়। শিল্পমান সমৃদ্ধ অনেক চলচ্চিত্রই প্রদর্শনের আওতার বাইরে থেকে যায় অশ্লীলতার অভিযোগে।

সব শ্রেণির দর্শকের বিনোদনের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে প্রেক্ষাগৃহটি। শাবিস্তান-এর দেখাদেখি গড়ে ওঠে সিনেমা প্যালেস (১৯২৪), লায়ন সিনেমা (১৯২৭), মুকুল (আজাদ) (১৯২৮-১৯২৯), প্যারাডাইস (১৯৩৮), মানসী (১৯৩৯), ব্রিটানিয়াসহ আরো কিছু প্রেক্ষাগৃহ।

সিনেমা প্যালেস হলো এই বাংলায় নির্মিত দ্বিতীয় প্রেক্ষাগৃহ। জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের জমি ইজারা নিয়ে ১৯২৪ সালে বাংলাবাজার এলাকায় প্রেক্ষাগৃহটি নির্মাণ করা হয়। উদ্যোক্তা হিসেবে উঠে আসে রূপলাল দাস, ধীরেন রায় ও শচীন ব্যানার্জির নাম; তবে ঠিক কে ছিলো এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিনেমা প্যালেস-এর নাম পরিবর্তন করে মতিমহল এবং তারও পরে রাখা হয় রূপমহল। বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আব্দুল জব্বারের মুখ ও মুখোশ মুক্তি দেওয়া হয় এই সিনেমা প্যালেস বা রূপমহল-এই। আর আমরা যেটাকে লায়ন সিনেমা বলছি সেটি আসলে ছিলো ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার। ১৮৮৭ সালে গড়ে ওঠা এই থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে অনেক নাটক। কিন্তু থিয়েটারের প্রতি দর্শকের আকর্ষণ কমে যাওয়ায় এটিকে প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তর করা হয়। আর সি এ প্রজেক্টরের মাধ্যমে এখানে একে একে বোম্বাই কি বিল্লী, আলিবাবা আওর চল্লিশ চোর, কিং সোলেমনস মাইনস্, জুলিয়াস সিজার-এর মতো চলচ্চিত্র প্রদর্শন হয়।

তাছাড়া সমকালীন প্রেক্ষাগৃহগুলোর মধ্যে মুকুল, প্যারাডাইস, ব্রিটানিয়ার অবস্থান ছিলো ঢাকাতেই। ঢাকায় প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ এবং নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রায় সমসাময়িককালে চট্টগ্রামে সিনেমা প্যালেসরঙ্গম সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। ...ত্রিশের দশকের শেষে নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয় বাণী সিনেমা, (পরের ডায়মন্ড সিনেমা) ত্রিশের দশকের প্রথম ভাগে বগুড়ায় মিনার, দিনাজপুরে লিলি, শেষভাগে ঢাকার তাজমহলমানসী (নিশাত) এবং ফরিদপুরের মায়ালোক প্রেক্ষাগৃহ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর বাইরে প্রেক্ষাগৃহ গড়ে উঠতে থাকে বিভাগীয় শহরগুলোর পাশাপাশি জেলা শহরেও।

প্রেক্ষাগৃহের বেহাল দশা

নেপথ্যে বিদেশি চলচ্চিত্র

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলে, এর প্রভাব এসে পড়ে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রত্যেক শাখায়। শিল্প-সাহিত্য যেহেতু সমাজ থেকেই উঠে আসে এবং সমাজই তৈরি করে দেয় শিল্প-সাহিত্যের প্রেক্ষাপট, তাই চলচ্চিত্রও বাদ পড়লো না দেশভাগের প্রভাবের এই আওতা থেকে। এর আগে বঙ্গভঙ্গ, বঙ্গভঙ্গ রদ, স্বদেশি আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুর প্রভাবও পড়েছিলো চলচ্চিত্রে। পাঠক, এটি সেই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া ভূখণ্ড, যেখানে রবীন্দ্র সঙ্গীত পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো!

১৯৪৭ সালে বাংলা যখন ভাগ হলো, কলকাতা মানে চলচ্চিত্র নির্মাণের উর্বর একটি জায়গা চলে গেলো ভারত অংশে। সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে ছিলো একশো ২০টি প্রেক্ষাগৃহ, যার অধিকাংশেরই মালিক ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। দেশ ভাগের ফলে অনেক হিন্দু চলে যান ভারতে, আর প্রেক্ষাগৃহের মালিকানায় আসেন পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা। খুব সম্ভবত ধর্মীয় কারণে এখানকার মুসলমানরা চলচ্চিত্র-নির্মাণ ও প্রদর্শন থেকে দূরে থাকতেন; তার পরেও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন অনেকেই। ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালে এসে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো একশো ২২টিতে। 

১৯৫৬ সালে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই আব্দুল জব্বার খান নির্মাণ করেন মুখ ও মুখোশ; যেটি ঢাকায়  নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তবে এ কথা সত্য, দেশভাগের পরও এখানকার প্রেক্ষাগৃহে বেশিরভাগই চলতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শন। তবে রমরমা ব্যবসা হলেও এখানকার প্রেক্ষাগৃহের তেমন গুণগত পরিবর্তন চোখে পড়ে না। কারণ, চলচ্চিত্রের মুনাফার অধিকাংশই চলে যেতো ভারতে। ১৯৫৪-তে যেখানে ছিলো একশো ২২টি প্রেক্ষাগৃহ, ১৯৫৮ সালে সেই হিসাব কমে দাঁড়ায় একশো ১০-এ। তবে এ সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে পূর্ব পাকিস্তানে, বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা হয় পি এফ ডি সি (পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন), সেই সঙ্গে এগিয়ে আসে বেশকিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও। ১৯৫৮ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালে একটি অধ্যাদেশ জারি করে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী।

মূলত বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বন্ধ করা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের আমদানি ও প্রদর্শন। এতে বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রেক্ষাগৃহের যে উন্নতি হয়নি সেটি পরিষ্কার। আর এই অনুন্নয়নের পিছনে যে সরকারের সদিচ্ছার অভাব ছিলো, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। একটি পরিসংখ্যান দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৯৫৪ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেক্ষাগৃহ ছিলো দুইশো ৩৮টি; মাত্র চার বছরে সেখানে আরো একশো ৩১টি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ হলেও পূর্ব পাকিস্তানের ১২টি প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় মালিকেরা। ১৯৬৮ সালে এসে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেক্ষাগৃহ চারশোতে উন্নীত হলেও বেড়ে-কমে ওই একশো ১০টিতেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে সরকার একশো ৫০টি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের বাজেট হাতে নিলেও সদিচ্ছার অভাবে মাত্র চারটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়।

সদিচ্ছার অভাবের পাশাপাশি তৎকালীন সরকার চলচ্চিত্র ব্যবসার ওপর চাপিয়ে দেয় করের বোঝা। আগে পূর্ব পাকিস্তানে টিকিটের ওপর প্রমোদ কর ছিলো ৭০ থেকে ১১০ শতাংশ; ১৯৬২ সালে এসে সেই পরিমাণ আরো ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রমোদ কর ছিলো এর তুলনায় অনেক কম। পাকিস্তানের এই দুই নীতির ফলে করের বোঝায় জর্জরিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রেক্ষাগৃহগুলো বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এ সময় কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রেখেও কোনো সুরাহা পাননি প্রদর্শকরা।

তবে আশার কথা হলো, ১৯৫৯ সালে সরকার চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেন; যার মধ্যে ২০ লক্ষ টাকা ছিলো প্রেক্ষাগৃহের জন্য। তবে প্রেক্ষাগৃহের জন্য এ বরাদ্দ মোটেও যথেষ্ট ছিলো না। তাছাড়া, ভারতীয় চলচ্চিত্র বন্ধ থাকায় প্রেক্ষাগৃহগুলো চলে যায় উর্দু চলচ্চিত্রের করায়ত্তে। বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে দর্শক কম আসলেও উর্দু চলচ্চিত্রের দর্শক হতো প্রচুর। প্রদর্শকরা সেসময় বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতেন উর্দু চলচ্চিত্র থেকে। জহির রায়হানের মতো নির্মাতাও বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবসায়িক সফলতা না পেয়ে ঝুঁকে পড়েন উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণে। সালাউদ্দিন ব্যর্থ হন সূর্যস্নান (১৯৬২) ও ধারাপাত (১৯৬৩) নির্মাণ করে। বাংলা চলচ্চিত্রের এ রকম সঙ্কটময় মুহূর্তে নিজেদের সংস্কৃতির একেবারে শিকড়ে ফিরে গিয়ে ১৯৬৫ সালে সালাউদ্দিন নির্মাণ করলেন রূপবান। যাত্রার কাহিনি নিয়ে নির্মিত রূপবান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। রূপবানকে দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করে নিজেদের চলচ্চিত্র হিসেবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের চলচ্চিত্র দর্শকের একটি বড়ো অংশ কিন্তু এসেছে যাত্রা থেকে।

২০ শতকের প্রথম ভাগে ঢাকায় স্থাপন হয় দুটি পেশাদার থিয়েটার মঞ্চ। যার একটি ১৮৮৭ সালে ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামপুরের অশোক (১৯২৭ সালে এসে থিয়েটারটি প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তর হয় লায়ন সিনেমা নামে)। আর অন্যটি হচ্ছে ক্রাউন থিয়েটার। থিয়েটার হলগুলোর পাশাপাশি জগন্নাথ কলেজ, বলধা গার্ডেন, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন মহল্লায়ও নাটক হতো নিয়মিতই।

আগেই বলেছি, যাত্রা ছিলো এ অঞ্চলের মানুষের যাপিত জীবনেরই একটি অংশ। যাত্রার আধেয়তে থাকতো রাজা-জমিদারদের নিয়ে নানা কাহিনি, পৌরাণিক কাহিনি। রাম-সীতা কিংবা রাজা-জমিদারের গল্পগাথার সঙ্গে পরিচিত এই অঞ্চলের মানুষেরা তাই রূপবানকে গ্রহণ করে নিজেদের চলচ্চিত্র হিসেবে। চলচ্চিত্রটির বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে একে একে নির্মাণ হতে থাকলো জহির রায়হানের বেহুলা (১৯৬৫), খান আতাউর রহমানের রাজা সন্ন্যাসী (১৯৬৬), দিলীপ ঘোষের সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮); কেবল রূপবান নামেই হয়েছিলো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্ররহিম বাদশা ও রূপবান (১৯৬৬), বনবাসে রূপবান (১৯৬৬)। চলচ্চিত্রগুলো দর্শককে বাধ্য করেছিলো প্রেক্ষাগৃহে আসতে। নিজেদের সংস্কৃতিকে চলচ্চিত্র মাধ্যমে দেখতে পেয়ে প্রেক্ষাগৃহে বাড়তে থাকলো দর্শকের সংখ্যা; অথচ তখনো বাড়লো না প্রেক্ষাগৃহ। ১৯৫৮ সালের একশো ১০টি প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা অপরিবর্তিত রইলো ১৯৬৮ সালে এসেও।


সঙ্কট-সম্ভাবনার নাম ক্যাপাসিটি ট্যাক্স

১৯৭১-এ শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের সময় চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই চলে যান দেশ ছেড়ে। তার পরেও মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিলো। যুদ্ধের পর পরই বেশ কয়েকজন নির্মাতা এগিয়ে আসলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণে। চাষী নজরুলের ওরা এগারো জন (১৯৭২), সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২), খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) উল্লেখযোগ্য। এই চলচ্চিত্রগুলো ছিলো মূলত বাণিজ্যিক উপাদানে ভরা। ফলে বেশকিছু চলচ্চিত্র ব্যবসাসফল হয়। রূপবান থেকে শুরু হওয়া চলচ্চিত্রের সফলতায় ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা দাঁড়ায় দুইশো আটটি।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রটি হোঁচট খায় ১৯৭৫ সালে; রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের হাওয়া লাগে চলচ্চিত্রশিল্পেও। চারদিকে তখন পশ্চিমা সংস্কৃতির তোড়জোড়। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি দেশগুলোর প্রভাব দেখা যায় আমাদের চলচ্চিত্রে। পাশাপাশি চলচ্চিত্রে নকলের ছড়াছড়ি, পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ, অশ্লীল নাচ-গান আর উদ্ভট কাহিনি; তবে এতকিছুর পরও চলচ্চিত্র ব্যবসা চলছিলো ভালোই। সেসময় প্রেক্ষাগৃহের প্রতি সরকারের সদিচ্ছারও প্রমাণ মিলে। ১৯৭৮ সালে এসে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা দুইশো ৬২টিতে উন্নীত হয়। ওই বছরেই দ্বি-বার্ষিক পুঁজি বিনিয়োগ কর্মসূচিতে বেসরকারি খাতে দুইশোটি স্বল্প ব্যয়ের প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। পাশাপাশি শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থাকে ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিলে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে এগিয়ে আসেন অনেকেই; যদিও পরবর্তী সময়ে এ ঋণ অব্যাহত রাখেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তার পরও নিজ উদ্যোগে অনেকেই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে এগিয়ে আসে।

১৯৮৩-১৯৮৪ অর্থবছরে সরকার প্রেক্ষাগৃহে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স চালু করে। প্রেক্ষাগৃহের আসন সংখ্যার ভিত্তিতে এ কর দিতে হতো। ক্যাপাসিটি ট্যাক্স চালুর ফলে কর নির্ধারণ হয়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত আয় থেকে সরকারকে কোনো কর দিতে হতো না। যার সুফলে প্রদর্শকের আয় বৃদ্ধি পেতে থাকে কয়েক গুণে; বিস্তৃত হতে থাকে প্রদর্শন ব্যবসা। ১৯৮৩ সালে সবমিলে চারশো ৮৫টি প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও ক্যাপাসিটি ট্যাক্স চালুর ফলে নির্মাণ হয় আরো তিনশো প্রেক্ষাগৃহ। বাংলাদেশ প্রদর্শক সমিতির তথ্যানুযায়ী ১৯৮১-১৯৯০ পর্যন্ত এদেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ছিলো নয়শো দুইটি। এই সময়েই নির্মাণ হয় বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোস্না (১৯৮৯)। এছাড়া ফেরারী বসন্ত (১৯৮৩), রসের বাইদানী (১৯৮৪), রঙিন রূপবান (১৯৮৫), দহন (১৯৮৫), তোলপাড় (১৯৮৮), রাঙা ভাবীর (১৯৮৯) ব্যাপক ব্যবসায়িক সফলতা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙা করে তোলে। এর পর ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহের এ সংখ্যা হয় এক হাজার দুইশো ৩০টি।

চলচ্চিত্রশিল্পে সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা লাগে ১৯৮৮-১৯৮৯ অর্থবছরে; ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বন্ধ করে আবারো পুরনো নিয়ম মেনে আবগারী স্ট্যাম্প চালু করা হয়। পূর্বে ৮ থেকে ১২ শতাংশ থাকলেও ১৯৯০ সালে এসে থানা পর্যায়ে বিনোদন কর ধার্য করা হয় শতভাগ। ওদিকে প্রদর্শকরাও টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দেন। এতে করে বিরূপ প্রভাব পড়ে থানা পর্যায়ের ছয়শো ১৫টি প্রেক্ষাগৃহে; বন্ধও হয়ে যায় কিছু সংখ্যক। এরপর আসে ৯০-এর দশক; স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রাদুর্ভাবে প্রেক্ষাগৃহের দর্শক সংখ্যা কমতে থাকে। তার পরও ৯০-এর দশকে এসে কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বেড়েছে।

এ সময় ঘরে বসে স্যাটেলাইট চ্যানেলে চলচ্চিত্র দেখার সুযোগে প্রেক্ষাগৃহের অনেক নিয়মিত দর্শকও ঝরে পড়ে। তাছাড়া শূন্যের দশকে এসে দুর্বল কাহিনি, অশ্লীলতা, প্রেক্ষাগৃহের নিম্নমান দর্শককে হলবিমুখ করে। একে একে বন্ধ হতে থাকে বিভিন্ন এলাকার প্রেক্ষাগৃহ। প্রদর্শক সমিতির সূত্রমতে, ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহ কমে দাঁড়ায় সাতশো ৪২টিতে। আর বর্তমানে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা চারশো ৫০টি

শুধু বন্ধ নয় অনেক প্রেক্ষাগৃহই ভেঙে ফেলা হয়েছে ইতোমধ্যে। সারের কিংবা খাদ্যের গুদাম করে ফেলা হয়েছে কতোগুলো। আবার যেসব প্রদর্শক চলচ্চিত্রের মায়া ছাড়তে না পেরে প্রেক্ষাগৃহটি এখনই ভাঙবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের অনেকেই মাঝে মাঝে দু-একটি চলচ্চিত্র চালিয়ে বেশিরভাগ সময় বন্ধ রাখছেন। আবার অনেকে চলচ্চিত্রের জায়গায় যাত্রা কিংবা ভ্যারাইটি শো চালিয়ে কিছু উপার্জনের চেষ্টা করছেন এই প্রেক্ষাগৃহ থেকেই।

এর মধ্যেও বেশকিছু প্রেক্ষাগৃহকে ডিজিটাল প্রদর্শনের আওতায় আনা হয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের এখানে একটু দেরিতে হলেও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করছে, পাশাপাশি সরকারও কিছু উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে।

এতক্ষণের আলোচনায় দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, কোন্ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থায় আমাদের প্রেক্ষাগৃহগুলো গড়ে উঠেছিলো। এখন দেখার চেষ্টা থাকবে, ঠিক কোন্ বাস্তবতায় ৮০র শেষে ও ৯০ দশকের শুরুতে নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল দেলুয়াবাড়ীতে দুইটি প্রেক্ষাগৃহ গড়ে উঠেছিলো; আর আজ এর অবস্থাই বা কেমন। বিষয়গুলোর উত্তর খোঁজার জন্য এথনোগ্রাফিক পদ্ধতি অনুসরণ করে দীর্ঘ এক মাস প্রেক্ষাগৃহ এলাকায় থেকে এর মালিক, সংশ্লিষ্ট লোকজন ও দর্শকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে প্রেক্ষাগৃহ দুটি নিয়ে জানাশোনা অনেক আগেরই। দীর্ঘদিনের দেখে আসা এবং এক মাসের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এই আলোচনাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে।

যাত্রার প্যান্ডেলে চলচ্চিত্রের যাত্রা

উত্তর-পশ্চিমের জেলা নওগাঁ। ১১টি উপজেলার মধ্যে মান্দার অবস্থান সর্বদক্ষিণে; একেবারে রাজশাহী-নওগাঁ জেলা সীমান্তে। মান্দার প্রত্যন্ত এক অঞ্চলের নাম দেলুয়াবাড়ী। বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তরের দেলুয়াবাড়ী নওগাঁ থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে। বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী, উৎপাদন সম্পর্কে তারা মূলত ভূমি শ্রমিক; সঙ্গে সামন্ত প্রভুদের প্রতাপ তো আছেই। ফলে খুব একটা বেশি এগোতে পারেনি মানুষগুলো। তবে প্রভুদের শিক্ষায় ঝোঁক ছিলো। সেই ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এই এলাকার প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছিলো উচ্চ বিদ্যালয়ও। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও স্বাধীনতাযুদ্ধের পর প্রথম মহাবিদ্যালয় গড়ে ওঠে এ অঞ্চলে। পিছিয়ে পড়া এ মানুষগুলোর বিনোদনের মাধ্যম ছিলো সাপখেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, কবিগান, মাদারের গান, আলকাপ গান আর হরি বাসর। তবে যাত্রাগান ছিলো এ অঞ্চলের বিনোদন মাধ্যমগুলোর অন্যতম।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মানুষের বিনোদনের বহুল জনপ্রিয় মাধ্যম যাত্রাগানকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন এই অঞ্চলের সংস্কৃতিমনা কিছু লোক। যারা এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন আবুল কালাম তাদেরই একজন; প্রচুর জমির মালিক এই মানুষটি, এক কথায় যাকে বলে সামন্ত প্রভু। কালাম ও তার কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে ১৯৭২-এ গড়ে তোলেন রজনীগন্ধা একতা বহুমূখী সংসদ (যার রেজি. নং-৪৩৮)। ক্লাবটি ছিলো মূলত এই মানুষগুলোর অবসর কাটানোর একটি জায়গা, সঙ্গে তারা টুকটাক সমাজসেবামূলক কাজও করতো। এটি চলতো সদস্যদের মাসিক চাঁদায়; টাকা জমা হতো সদস্যদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একজনের কাছে। উদ্দেশ্য, জমানো টাকা দিয়ে টুকটাক কিছু কাজ করার পাশাপাশি সদস্যদের নিয়ে বিশেষ দিনে পিকনিকের আয়োজন করা। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে এই ক্লাব থেকে আয়োজন করা হতো নাট্যানুষ্ঠানের।

ধান কাটার পর কিংবা শীত মৌসুমে সদস্যরা অবসর পেলে নিজেরা মিলে বিভিন্ন নাটকের রিহার্সেল করতো। মাস দুয়েক মহড়ার পর গণচাঁদা তুলে ব্যবস্থা হতো নাটক মঞ্চায়নের। নাটকে সদস্যরা নিজেরা অভিনয় করলেও নারীশিল্পী, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ও বাদককে ভাড়া করে নিয়ে আসা হতো কোনো যাত্রাদল থেকে। গ্রামের মানুষ এই আয়োজনকে বলতো ড্রামানাটক। এভাবেই চলছিলো; পরবর্তী সময়ে ক্লাবের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেয় যাত্রাদল নিয়ে এসে দর্শনীর বিনিময়ে তা দেখানোর।

এরপর দেলুয়াবাড়ীতে তারা আয়োজন করে যাত্রানুষ্ঠানের। দর্শক-চাহিদা দেখে পরবর্তীকালে ক্লাবের পক্ষ থেকে পার্শ্ববর্তী সাবাই হাট, চৌবাড়িয়া হাট, পানিয়াল, একরুখী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ও তেঁতুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্যান্ডেল নির্মাণ করে যাত্রা দেখানো হয়। যাত্রা প্রদর্শনীর উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হতো বিশেষ করে শীত মৌসুমকেই; জমজমাট আয়োজনে তা শুরু হতো মধ্যরাতে। এই উৎসব চলতো এক নাগাড়ে পাঁচ থেকে সাত দিন; দর্শক ছিলো নারী-পুরুষ, ছোটো-বড়ো সবাই।

যাত্রানুষ্ঠানে রজনীগন্ধা ক্লাবের সফলতা দেখে সমসাময়িকে গড়ে ওঠে আরো দু-একটি ক্লাব। এদের মধ্যে অন্যতম শ্রীরামপুর টাইগার ক্লাব (১৯৭৪/৭৫), একরুখী প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার মিলন সংঘ (১৯৭৭)। এ ক্লাবগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও যাত্রা আয়োজনের কথা শোনা যায়। এদের মধ্যে অন্যতম সাবাই হাটের মিষ্টি ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র। যাত্রা যেখানেই হোক না কেনো প্রত্যেক আয়োজনে বিপুল সংখ্যক লোকসমাগম হতো। এভাবেই চলছিলো ১৯৮০ সাল অবধি। এরপর ক্লাবের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেয়আর শিল্পী ভাড়া করবে না, নিজেরাই যাত্রাদল করবে। রজনীগন্ধা থেকে একটি যাত্রাদল গঠন করা হয় ১৯৮১ সালের দিকে।

প্রথম দিকে এই দলের যাত্রা দেখতে লোক সমাগম ভালো হলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। ফলে ক্ষতির মুখ দেখতে থাকে দলটি। দীর্ঘদিন ধরে যাত্রা দেখে আসা এসব মানুষ কেনো জানি যাত্রা দেখতে আসছিলো না! বিনোদনের বিকল্প কোনো মাধ্যম অবশ্য তখনো হাজির হয়নি। এ নিয়ে ক্লাবের সদস্যরা এলাকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেননারী অভিনয়শিল্পীদের কারণেই আসলে দর্শক আগ্রহ বোধ করছে না।

রজনীগন্ধা ক্লাবের যাত্রায় মূলত নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নেওয়া হয় দেলুয়াবাড়ী বাজার পার্শ্ববর্তী কইকুঁড়ি (অনেকের কাছে জায়গাটি হঠাৎ পাড়া নামেও পরিচিত) থেকে। ভূমিহীন নিঃস্ব কতোগুলো নিম্নবর্গের মানুষের বাস ছিলো সেখানে। জীবিকার জন্য যাদের অনেকেই যৌনকর্মীর কাজ করতো। মোদ্দাকথা, যাত্রাগানের নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলো এই যৌনকর্মীরাই। এর আগে যখন যশোর থেকে নারী ভাড়া করে যাত্রা করানো হতো, তখন কিন্তু ঠিকই দর্শক এসেছিলো। কিন্তু দর্শকের কাছে সঙ্কটটি দেখা দিলো দেলুয়াবাড়ীরই নারীরা অভিনয় করায়। চেনা নারী অভিনেত্রীদের তারা মঞ্চে মেনে নিতে পারছিলো না! অথচ চেনা পুরুষের বেলায় কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি।

ফলে, দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে বিনোদন দিয়ে আসা এই মানুষজন খানিকটা বাধ্য হয়েই যাত্রাদল বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে কিছুদিন। ১৯৮২ সালের শেষের দিকে ক্লাবের বাৎসরিক পিকনিকের আয়োজনে সদস্যরা  খুলনায় যায়। সেখানেই কোনো একটি (জোনাকি সম্ভবত) প্রেক্ষাগৃহে তারা চলচ্চিত্র দেখে এবং সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ জন্মে। ততোদিনে অবশ্য রাজশাহীর প্রেক্ষাগৃহেও নিয়মিত প্রদর্শনী চলছিলো। স্মৃতি সিনেমা, কল্পনা, বর্ণালী তখনকার বিখ্যাত সব প্রেক্ষাগৃহ। এসব প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকের আগ্রহ আগে থেকেই লক্ষ করছিলো ক্লাবের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন। তার সঙ্গে যোগ হয় খুলনার সেই অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে তারা কথা বলে খুলনার সেই প্রেক্ষাগৃহের মালিক ফকির আহমেদের সঙ্গে। পরে জাহাঙ্গীর আলম নামের আরেক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় ফকির আহমেদের মাধ্যমেই। জাহাঙ্গীরের নিজের প্রেক্ষাগৃহ ছিলো না; তিনি মূলত ১৬ মিলিমিটার প্রজেক্টর ও চলচ্চিত্রের রিল ভাড়ার ব্যবসা করতেন। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলে ক্লাবের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন ভাড়ায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী আয়োজনের।

এক্ষেত্রে বাড়তি কিছু সুবিধা আকৃষ্ট করেছিলো রজনীগন্ধা ক্লাবের সদস্যদের। যাত্রাগানের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো, চলচ্চিত্রের বেলায় সেসবের বালাই নেই। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপারটি হলো চলচ্চিত্র দিনে একাধিকবার প্রদর্শন সম্ভব; অথচ যাত্রাগানের ক্ষেত্রে সেটি ছিলো প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে যাত্রা দেখে আসা মানুষদের রুচি, ধারণা ও অভ্যাসেও কিছু পরিবর্তন এসেছিলো। তাই তখন দরকার ছিলো এক বড়ো ধরনের সৃষ্টিশীলতা, যা আমূল পাল্টে দিবে শিল্পকলার যাবতীয় শৈলী, যা প্রভাবিত করবে শৈল্পিক উদ্ভাবনাকে, আর সম্ভবত রোমাঞ্চকর পরিবর্তন আনবে শিল্পকলা সম্পর্কিত আমাদের বর্তমান ধারণায়; এ রকম সব ভাবনা-চিন্তা থেকেই ভাড়ায় প্রজেক্টর আনা। যাত্রা গানের স্থানে এবারে দেখানো হবে নবীনতম যান্ত্রিক শিল্পমাধ্যমচলচ্চিত্র।

প্রথমের দিকে সপ্তাহব্যাপী চলতো এ প্রদর্শনী। রাস্তায় রাস্তায় ক্যানভাসার সুরেলা কণ্ঠে অনেকটা যাত্রার ঢঙেই বলতো, সুদূর খুলনা থেকে আগত, ১৬ মিলিমিটারে দেখানো হবে টুরিং সিনেমা, দেলুয়াবাড়ী রজনীগন্ধা ক্লাবে এখন চলছে অমানুষ-অমানুষ-অমানুষ। এছাড়া হাড়িদের (নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়) কেউ একজন কোনো একটি বাজারের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে ঢোলে বাড়ি দিয়ে বলতেন, সুখবর, সুখবর, সুখবর; অতি আনন্দের খবর। দেলুয়াবাড়ী রজনীগন্ধা ক্লাবে বিশাল পর্দায় সিনেমা দেখানো হচ্ছে, আপনারা সবাই বউ, ছাওয়াল, শালা, শালি নিয়ে উপস্থিত হন। দেরি করলে ভুল করবেন ভাইয়েরা। ওদিকে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘিরে ক্লাবের পাশেই নির্মাণ করা হয় প্যান্ডেল। অতঃপর আসে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের দিন। টিকিট সংগ্রহ করা দর্শকরা শুরুর অনেক আগেই ভিতরে ঢোকার জন্য লম্বা সারিতে ভিড় করতে থাকে।

বিপুল সংখ্যক দর্শকের চলচ্চিত্রের প্রতি টান আর প্রদর্শন ব্যবসায় লাভ দেখে অনেকটা নিয়মিতভাবেই প্রদর্শনী চলতে থাকে ক্লাবের উদ্যোগে। ১৯৮৭ সালে এসে ক্লাবের কয়েকজন সদস্যআবুল কালাম, নুরুজ্জামান পিটার, প্রামাণিক মিলে নিজেদের উদ্যোগে ব্যক্তি মালিকানায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের চিন্তা শুরু করেন।

না জেনে বেদ-বিধান

হারাম তোমরা বলো ক্যান

দেলুয়াবাড়ীর পরিবর্তে এবার মান্দা উপজেলা সদরে গিয়ে অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করে রজনীগন্ধা ক্লাব। ততোদিনে অবশ্য ক্লাব কমিটি নিজেরাই প্রদর্শনের যন্ত্রপাতি কিনে ফেলেছে। বিপুল সংখ্যক দর্শক নিয়ে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভালোই চলছিলো প্রদর্শন ব্যবসা। মাস দুয়েক এভাবেই চলার পর বাধা আসে উপজেলা পরিষদ মসজিদ কমিটি থেকে। মসজিদ কমিটির চাপের মুখে বন্ধ করে দেওয়া হয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী।

শুধু উপজেলা চত্বরে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি ধর্মপ্রাণ এই মানুষগুলো। তারা সব জায়গায় প্রদর্শনী বন্ধে সব রকমের চেষ্টা করে গেছেন; দর্শকদের মধ্যে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছেন, এখনো সেই ধারা অল্পবিস্তর অব্যাহত আছে! উৎসবগুলোতে এলাকার লোকজনের বিনোদনের অন্যতম স্থান হয়ে ওঠে এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। ঈদের দিন প্রেক্ষাগৃহে না গেলে এই দর্শকের আনন্দে পূর্ণতা আসতো না, অথচ ঈদগাহে নামাজের পর চলচ্চিত্র দেখার প্রতি একধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ধর্মকে সরাসরি এর বিপরীতে দাঁড় করানো হয়। মুসল্লিদের উদ্দেশে বলা হয়, কেয়ামতের দিন তিনটি স্থান ধ্বংস হবে না; মসজিদ, মন্দির আর সিনেমাহল। এই স্থানগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের জান্নাত কিংবা জাহান্নামে না পাঠানো পর্যন্ত ধ্বংস হবে না। এছাড়া সিনেমাহলে যেনো বাড়ির ছেলে-মেয়েরা না যেতে পারে সেজন্যও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানানো হতো।

চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু মাত্র একশো বছর আগে; অথচ ইসলামে নাকি তা নিয়ে আলোচনা আছে। প্রেক্ষাগৃহ চালুর ১৩শো বছর আগে নাকি ইসলামে একে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে! বিষয়টি অনেকটাই মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধুশহীদে কারবালা অংশের আজর চরিত্রের মতো। শহীদে কারবালা অংশে লেখক বলছেন, কারবালা প্রান্তর থেকে দামেস্ক যাচ্ছে সীমার, হাতে হোসেনের ছিন্ন মস্তক। পথিমধ্যে রাত হলে সীমার আশ্রয় নেয় এক বাড়িতে, যে বাড়ির মালিক একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। অথচ কারবালা আর দামেস্কের মাঝপথে কোনোক্রমেই ভারতীয় ব্রাহ্মণের থাকার কথা নয়। বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থে আহমদ ছফা বলেন, তিনি যদি তার বদলে ইরানি, তুরানি, ইহুদি, খ্রিস্টান, তাতার, তুর্কি ইত্যাদি যে-কোন জাতির, যে-কোন ধর্মের মানুষের সঙ্গে সীমারের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিতেন, তাহলে পাঠকের মনে কোনো প্রশ্নই জাগতো না।১০ অথচ লেখক ব্রাহ্মণকেই টেনে আনলেন; সেখানে ব্রাহ্মণের বসবাস না থাকলে কী হবে, তিনি (মোশাররফ) তো এই জাতটার প্রতি খ্যাপা।

বয়সে প্রবীণ মমতাজ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি খেপে যান। তার ভাষায়, ঢপটা (খারাপ কিছুকে নওগাঁর আঞ্চলিক ভাষায় ঢপ বলা হয়) বন্ধ হয়েছে, তুমি আবার ভ্যাক (বিষয়টা নিয়ে অতি আগ্রহ দেখানো) লাগাইছো। পাঠক, তার বলা কথা থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, প্রেক্ষাগৃহ কিংবা চলচ্চিত্রের প্রতি কতোটা খ্যাপা এই মানুষটি। তার এই প্রতিক্রিয়া দেখানোর পিছনে হয়তো কাজ করেছে দীর্ঘদিনের ধর্মীয় অনুশাসন। ধর্ম সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানা এই মানুষটির কাছেই জানতে চাওয়া হয়, তিনি কখনো চলচ্চিত্র দেখেছেন কি না? জবাবে তিনি বলেন, আমি কোনোদিন ওর আশপাশ দিয়্যাও যায়নি। ওর মধ্যে যাওয়া আর দোজখের মধ্যে যাওয়া একই কথা। এসব বিষয় দেখে ক্ষুব্ধ ছফা বলেন, যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না, অথবা সেগুলোকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়।১১ অথচ গ্রামের একদল মানুষ চলচ্চিত্রকে কোনোভাবেই শিল্প হিসেবে গ্রহণ করেনি। শিল্প কিংবা প্রযুক্তির বদলে তারা এটিকে মনে করেছে পাপের জিনিস হিসেবে।

শেষ পর্যন্ত উপজেলা চত্বরে আর চলচ্চিত্র দেখানো সম্ভব হয়নি। উপজেলা চত্বরে প্রদর্শনী চালাতে না পারলেও একেবারে বসে থাকেননি সংস্কৃতিমনা এই মানুষগুলো। আবার ফিরে এসেছেন নিজ এলাকায়; রজনীগন্ধা ক্লাবের পাশেই নিজেদের জায়গায় চাটাই দিয়ে ঘিরে কাপড়ের ছাউনির জায়গায়, টিনের ছাউনি দিয়ে স্থায়ীভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন ১৯৮৮ সালেই। প্রামাণিক, আবুল কালাম ও নুরুজ্জামান পিটার মিলে এই প্রেক্ষাগৃহটির নাম দেন চলন্তিকা। ব্যবসায়িকভাবে প্রেক্ষাগৃহটির যাত্রা শুরু হয় নিয়তির খেলা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। বিপুল সংখ্যক দর্শকের কারণে প্রদর্শন ব্যবসা ভালোভাবে চলায় আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্টদের। মাত্র দুবছর পরে ১৯৯০ সালে এর মালিকরা ইটের তৈরি বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ করেন।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, উপজেলা চত্বরের চারপাশ, যেখানে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিতআধুনিক মধ্যবিত্তের বাস, সেখানে প্রেক্ষাগৃহ মানে নতুন এই প্রযুক্তিকে মেনে নিতে সমস্যা হওয়ার কথা না। অথচ তারাই মূল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলো। অবশ্য মধ্যবিত্তের এই টানাপড়েন নতুন নয়। অথচ দেলুয়াবাড়ী বাজার, যেখানে সাধারণ মানুষের বসবাস, সেখানে এসে ঠিকই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ সম্ভব হলো। তাহলে কি গ্রামের এই মানুষগুলো নতুন কোনো কিছুকে গ্রহণের ব্যাপারে সহনশীল? নাকি এরা অনেক বেশি সচেতন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অবশ্য খুব সহজ হবে না। তবে উদ্যোক্তা আবুল কালাম বলেন, কিছু সমস্যা যে ছিলো না তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের ইতিবাচক সাড়া ছিলো। তারা এটিকে স্রেফ বিনোদন হিসেবে নিয়েছিলো। এই পরিস্থিতি না হলে এখানে হল বানানো সম্ভব হতো না। তার পরও দেলুয়াবাড়ী পার্শ্ববর্তী মল্লিকপুর ক্বওমী ও হাফেজিয়া মাদ্রাসার সামনের রাস্তা দিয়ে মাইকে প্রচার বন্ধ করে যেতো হতো ক্যানভাসারদের। ছোটোখাটো এ রকম ঘটনা বাদ দিলে প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে নারী-পুরুষ, ছোটো-বড়ো, হিন্দু-মুসলিম সব শ্রেণির মানুষের সমর্থন ছিলো।

প্রতিদিন চলতো চারটি শো, প্রায় হাউজফুল দর্শক থাকতো সবগুলোতেই। সর্বশেষ শো, মানে নয়টা থেকে ১২টা, সেখানেও নারী দর্শকের সংখ্যা ছিলো বেশি। শ্রীরামপুর গ্রামের রোজিনা বেগম ১৯৯০-৯১ সালে চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, হামি তকন নতুন বউ। রাতে খাওয়া-দাওয়া শ্যাষে বাড়ির বেবাকে শুয়্যা পড়ে। আর হামরা (স্বামীসহ) বাড়িত থাইকে বাইর হই। ১২ডার শো ছাড়লে রাস্তাত সব সিনেমা দেকা মানুষ, মিয়ারাই বেশি। ওই পাড়ার নাদিরা তো পত্যেক সপ্তায়েই যায়। হামরা যতোদিন সিনেমা দেকিচি ওর সাতে দেকা হোচে।

সপ্তাহজুড়ে প্রদর্শনের পর শুক্রবারে আসতো নতুন চলচ্চিত্র। তবে কখনো কখনো একই চলচ্চিত্র চলতো দুই সপ্তাহ কিংবা তারও বেশিস্মৃতি হাতড়িয়ে কথাগুলো জানালেন চলন্তিকার সেই সময়ের ব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক। প্রেক্ষাগৃহটির সামনের বিশাল জায়গা (বর্তমানে সেখানে ধানের ক্ষেত) দেখিয়ে বলেন, এই যে এত্তগুলা জায়গা, সব ভরে যেতো সাইকেলে। আর ওই পাশে তো হাটের চেয়েও বেশি সাইকেল থাকতো। খুবই ব্যস্ততার মধ্যে থাকতাম। লোকজন প্রচুর আসতো। ঈদের সময় তো জায়গা দেওয়া মুশকিল ছিলো। তখন বাড়তি চেয়ার ঢোকানো হতো।

চলন্তিকা থেকে একশো গজ

দূরে ফাইভ ষ্টার

মালিকানার অংশীদারিত্ব নিয়ে কোন্দলে ১৯৯১ সালে প্রেক্ষাগৃহ থেকে অংশীদারিত্ব তুলে নেন আবুল কালাম ও প্রামাণিক। প্রেক্ষাগৃহের সম্পূর্ণ মালিকানা চলে যায় নুরুজ্জামান পিটারের হাতে। চলন্তিকার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেই আরেকটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের কথা ভাবেন কালাম। চলচ্চিত্র দেখা মানুষের ভিড় তাকে আকৃষ্ট করেছিলো দেলুয়াবাড়ীতেই আরেকটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের প্রতি। দর্শকের চাহিদা দেখে ১৯৯২ সালে চলন্তিকার একশো গজ দূরেই নির্মাণ হয় ফাইভ ষ্টার প্রেক্ষাগৃহ। কালাম বলেন, পাশাপাশি দুটি প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও দর্শকের কোনো সঙ্কট ছিলো না সেসময়। সপ্তাহজুড়েই দর্শক আসতে থাকে সমান হারে; তবে শনি ও মঙ্গলবার প্রেক্ষাগৃহে ভিড় ছিলো মূলত হাটে আসা মানুষজনদেরই। এছাড়া সুষ্ঠুভাবে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের পিছনে প্রশাসনের সহযোগিতার কথাও স্বীকার করেন তিনি। চলচ্চিত্রের প্রদর্শনে যাতে কোনো রকম বিঘ্ন না ঘটে সে ব্যাপারে তিনি প্রশাসনের সমর্থনের কথাও জানান।

ফাইভ ষ্টার-এর উদ্বোধন হয়েছিলো শাসন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে; পরবর্তী সময়ে ছুটির ঘণ্টা, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, বিয়ের ফুল; আরো পরে এসে নসিমন, মূসা ভাই, আসলাম ভাই, ধোকা ছাড়াও প্রদর্শন করা হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। প্রেক্ষাগৃহটি নির্মাণের সমসাময়িক মানে ৯০-এর দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে নকল প্রবণতা, দুর্বল কাহিনি আর অশ্লীলতার ছড়াছড়ির কথা তো আগেই বলেছি। তার পরও কিন্তু দর্শক হলবিমুখ হয়নি। এক শো ছাড়ার পর পরই টিকিট কাউন্টারের সামনে দেখা যেতো একটি লম্বা লাইন। আর পাশের সাইকেল গ্যারেজে শুরু হতো হৈ-হুল্লোড়; একদিকে চলচ্চিত্র দেখা দর্শকের বাড়ি ফিরার আগ্রহ, অন্যদিকে পরের শো ধরার ব্যাকুলতা।

প্রেক্ষাগৃহ দুটির চলচ্চিত্রের পোস্টার শোভা পেতো রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এর বাইরে ভ্যানের উপর দোচালা ঘরের মতো করে পোস্টার টাঙিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াতো ক্যানভাসাররা। চলতি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় কোনো গানের ফাঁকে ক্যানভাসারের কণ্ঠে ভেসে আসতো, শুভেচ্ছা, অভিনন্দন... বর্তমানের হিট নায়িকা, যার কথা শুনলেই বুকের ভিতর, হ্যাঁ আপনার বুকের ভিতর ধুকপুক-ধুকপুক করে, সেই নায়িকা পপির কথাই বলছি; বর্তমানের পর্দা কাঁপানো নায়ক, অ্যাকশন হিরো, প্রেমিক পুরুষ মান্না, মমতাময়ী মা ডলি জহুর, নায়ক রাজ রাজ্জাক, দানব ভিলেন মিশা সওদাগর, গাঙ্গুয়া, কাবিলাসহ মারমার কাটকাট সম্পূর্ণ অ্যাকশন সিনেমা...। একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প, ভিলেনের প্রতারণা আর শত বাধা উপেক্ষা; হ্যাঁ বন্ধুরা, আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, দেলুয়াবাড়ী চলন্তিকা/ফাইভ ষ্টার সিনেমাহলে; সম্পূর্ণ রঙিন রুপালি পর্দায়, এখন চলছে...।

চলচ্চিত্রের পোস্টার দেখে আর ক্যানভাসারের কথাগুলো শুনতে শুনতে চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ জন্মাতো অনেকের। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একজন সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন এভাবে, ক্যানভাসারদের কথা আর পোস্টারে নায়ক-নায়িকার ছবি দেখে আকৃষ্ট হয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে চলন্তিকায় গিয়েছিলাম। ২০০৫ সালের ঘটনা, তখন বয়স ১৩ কি ১৪ হবে। বিলাসের (দোতলার) টিকিট নিয়ে ভিতরে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছি, বারান্দায় তখন প্রচুর দর্শকের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। দর্শকের ঠেলাঠেলিতে দোতলার একেবারে শেষপ্রান্তে এসে ঠেকেছি। আশঙ্কা হচ্ছিলো, এই বোধ হয় নচে পড়ে যাবো; ভয়ে আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম।

আবার সেই যাত্রা

আড়ালে ভ্যারাইটি শো

২০০৮ সালের পর থেকে চলন্তিকাফাইভ ষ্টার-এ দর্শকের সেই উপস্থিতি আর চোখে পড়েনি। শূন্য দশকের শুরু থেকেই এ অঞ্চলে স্যাটেলাইট চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়, সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রে দুর্বল কাহিনি, প্রেক্ষাগৃহের বেহাল দশা ও পর্নোগ্রাফি-নির্ভর চলচ্চিত্রের কারণে মানুষজন প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। একসময়ের নিয়মিত দর্শক রাজ্জাক বলেন, গরমের সময় দোজখরে ভাই। কে থাকে ওর মধ্যে? কী দরকার আমার? তারচেয়ে      টিভি-ই ভালো। বাড়িতে ২১ ইঞ্চি কালার টিভি আছে। পাড়ার সবাই তো ওটাতেই দেখে। ইচ্ছে থাকলেও এখন অনেকেই প্রেক্ষাগৃহে যেতে পারছে না, অন্যভাবে বললে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। কম্পিউটার ছাড়াও কমদামি মাল্টিমিডিয়া মুঠোফোনেও দেখা যাচ্ছে চলচ্চিত্র। সেই সঙ্গে পাড়ার মোড়ে মোড়ে গড়ে ওঠা মিনি প্রেক্ষাগৃহ মানে টি স্টলে তো চলচ্চিত্র দেখানো রুটিনে পরিণত হয়েছে। 

প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে তো বটেই পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়ে, চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের নিয়েও অভিযোগ কম নেই। বাংলা চলচ্চিত্রে একনায়কত্বের যে ব্যাপার, সেটি তো বহু পুরনো কথা; অভিযোগ আছে অভিনয় নিয়েও। ফারুক নামের একজনের অভিযোগ, এখন যারা অভিনয় করে, তাদের এগুলো হয় না। সাকিবের (ক্রিকেটার) জন্য আমি মাঠে গিয়ে খেলা দেখি, কিন্তু কোনো অভিনেতা তো আমাকে হলে টানতে পারে না। তেমন কেউ হলে অবশ্যই হলে যাবো।

দর্শককে না টানতে পেরে চলন্তিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ২০১২ সালে। প্রেক্ষাগৃহের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা থেকেই হয়তো ফাইভ ষ্টার চালু রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন আবুল কালাম। ২০০৯ সালের পর থেকে দুটো প্রেক্ষাগৃহেই এক টিকিটে দুই ছবি দেখানো হতো। মানে একটি ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র দেখানোর পাশাপাশি বিরতির পর পর্নোগ্রাফি দেখানো হতো। কিন্তু তাতেও খুব বেশি লাভ হলো না। সোহরাব নামের একজন ফাইভ ষ্টার-এ এক টিকিটে দুই ছবি দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সিনেমা শেষে আমি মুখ ঢেকে বের হয়েছি। কী যে লজ্জা লাগছিলো! কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে ভাববে, আমি এক্স (পর্নো) দেখে বের হচ্ছি।

চরম সঙ্কটের এই মুহূর্তে বাধ্য হয়েই প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রের বদলে এখন আয়োজন করা হয় আবার সেই যাত্রা ও ভ্যারাইটি শো। দিনের বেলা চলে ভ্যারাইটি শো এবং রাতে থাকে যাত্রার আয়োজন। এসব আয়োজনে আকর্ষণ হিসেবে নিয়ে আসা হতো বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। এ ব্যাপারে ফাইভ ষ্টার-এর মালিকের বক্তব্য, কুলাবার না পেরে মাঝে মধ্যে শিল্পী নিয়ে এসে শো চালাইছি। উপায় না থাকলে কী করবো? দেখি কী হয়? চলচ্চিত্র দেখতে না আসলেও যাত্রাগান কিংবা এসব ভ্যারাইটি শোর দর্শক হয় প্রচুর। সপ্তাহখানেক এসব অনুষ্ঠান চলার পর আবার বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রেক্ষাগৃহ। তবে বন্ধের মধ্যেও মাঝে মাঝে নিয়ে আসা হয় ব্যবসাসফল দু-একটি চলচ্চিত্র। বর্তমানে কেবল ঈদ উপলক্ষেই প্রেক্ষাগৃহটি চালু করতে দেখা যায়।

গত কোরবানির ঈদে (২০১৩ সালে) পরিবেশকের মাধ্যমে ঢাকা থেকে ডিজিটাল প্রজেক্টর ভাড়ায় এনে দেখানো হয়েছে দেহরক্ষী; চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের পর থেকেই প্রেক্ষাগৃহটি বন্ধ আছে বর্তমান অবধি (মে ২০১৪)। কালাম বলেন, বর্তমানে ডিজিটাল সিনেমার ফলে পজিটিভ অনেক কিছু দেখছি। গত ঈদে সিনেমা দেখতে অনেক লোক হয়েছিলো। মেশিনটা ভাড়া নিয়েছিলাম। প্রচুর খরচ, ওভাবে চালানো যাবে না। আমি ডিজিটাল একটা মেশিন কিনার টার্গেটে আছি, কিন্তু কুলাবার পারছি না। এখন হল সাময়িক বন্ধ আছে, তবে চালু করবো।

বাস্তবতা ও কিছু ধূসর স্মৃতি

যেই যাত্রার প্যান্ডেলে একসময় শুরু হয়েছিলো চলচ্চিত্রের পথচলা, সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে সেই ধারা। প্রদর্শকদের পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। যদিও প্রেক্ষাগৃহের ইতিহাসে সঙ্কট নতুন ঘটনা নয়; শুরু থেকেই বার বার হোঁচট খেয়েছে, আবার নতুন করে শুরু হয়েছে পথ চলা। তবে, যতোদূর সম্ভব বাংলাদেশে গত একশো বছরে প্রেক্ষাগৃহের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো সঙ্কটটি তৈরি হয়েছে বর্তমান সময়ে। অথচ চলচ্চিত্রের দর্শক কিন্তু কমেনি বরং বেড়েছে। বিপুল সংখ্যক দর্শকের চাহিদা থেকেই ১৯৮৮ সালে দেলুয়াবাড়ীর মতো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়েছিলো চলন্তিকা; মাত্র চার বছরের মাথায় এই দর্শকের চলচ্চিত্র প্রীতির কারণেই চলন্তিকার পাশে নির্মাণ সম্ভব হয়েছিলো ফাইভ ষ্টার-এর। নিম্নবর্গের মানুষ, যারা এই প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে দর্শক হয়ে সহযোগিতা করেছিলো এবং পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে ছিলো; দিনের পর দিন প্রেক্ষাগৃহে তারাই উপেক্ষিত হতে থাকলো।

লোককাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে যে প্রেক্ষাগৃহের যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেই ইতিহাস, সেই দর্শকের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে থাকলো গুটিকয়েক মধ্যবিত্ত দর্শকের জন্য। অথচ এই মধ্যবিত্ত কিন্তু কোনো দিনই চলচ্চিত্রের ভালো দর্শক ছিলো না। বরং প্রেক্ষাগৃহের নিয়মিত দর্শক নিম্নবর্গের এই মানুষেরা প্রেক্ষাগৃহকে গ্রহণ করেছিলো আত্মিক জায়গা থেকে। প্রেক্ষাগৃহ তাদের কাছে ছিলো তারেক মাসুদের ভাষায়, মসজিদ, মন্দিরেরই মতো; সর্বোপরি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো প্রেক্ষাগৃহের প্রতি। যাদের সহযোগিতার কথা স্বীকার করছেন প্রেক্ষাগৃহের মালিকরাও।

নিম্নবর্গের এই দর্শকরা বার বার প্রেক্ষাগৃহে এসেছেন; তাদের খোরাক না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। এতো দেওয়ার পরও চলচ্চিত্র তাদেরকে আপন করে নিতে পারেনি। ফলে সেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অন্যভাবে বললে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বিনোদনের জায়গা খোঁজার চেষ্টা করছে এই মানুষেরা। চলচ্চিত্র যদি আবার আমাদের প্রধান দর্শক নিম্নবর্গের এই মানুষজনের কথা বলে, প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রিক একটি পরিবেশ গড়ে ওঠে; নিঃসন্দেহে তারা আবার ফিরে আসবে।

 

লেখক : কাওসার বকুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

bokulmcj71@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. পারভেজ, রুবেল; আব্বা হুজুরের দেশে চলচ্চিত্র পরিবেশন ও প্রদর্শন ব্যবস্থার হালচাল : উত্তরণে প্রজা সকলের ঘুমন্তচিন্তা; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩, পৃ. ৩৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

২. ইতোপূর্বে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হতো মাত্র পাঁচ কেজি ওজনের সিনেমাটোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে। আর সি এ প্রজেক্টর ছিলো এর তুলনায় অনেক বড়ো।

৩. কাদের, মির্জা তারেকুল (১৯৯৩ : ৪০০); চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা ও প্রদর্শন; বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প; বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

৪. প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখা প্রত্যেক দর্শককে বিনোদন কর দিতে হতো। প্রত্যেক টিকিটের সঙ্গে স্ট্যাম্প লাগিয়ে আদায় করা হতো এই কর।

৫. ঝুমা, জান্নাতুল ফেরদৌস; বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহ : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ; বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল; বর্ষ ৬, সংখ্যা ৬, জুন ২০১৩, পৃ. ৯, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা।

৬. প্রাগুক্ত; ঝুমা, জান্নাতুল ফেরদৌস (২০১৩ : ১১)।

৭. ভ্যারাইটি শো হলো ধ্বংসপ্রায় যাত্রা শিল্পের শেষ চেহারা। অভিনয়, জাদু, সার্কাস দেখানোর কথা বলে দর্শকদের এখানে টানা হলেও বাস্তবে এর কিছুই সেখানে দেখানো হয় না। ঝুমুর যাত্রার নৃত্যশিল্পীদের ভাড়ায় এনে গানের সঙ্গে অর্ধ নগ্ন কিংবা কখনো কখনো নগ্ন করে নাচানো হয়। দর্শকরা টাকার বিনিময়ে উপভোগ করে এই আয়োজন।

৮. পল ভালেরি, উদ্ধৃত; বেঞ্জামিন, ওয়াল্টার; যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা; ভাষান্তর : জাকির হোসেন মজুমদার ও মোহাম্মদ আজম; যোগাযোগ; সম্পাদনা : ফাহমিদুল হক ও আ-আল মামুন; সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ. ৫৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

৯. ভ্রাম্যমাণ কোনো স্থানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনকে সেসময় টুরিং সিনেমা বলে ডাকা হতো।

১০. ছফা, আহমদ (২০১৩ : ২০); বাঙালি মুসলমানের মন; বাঙালি মুসলমানের মন; খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা।

১১. প্রাগুক্ত; ছফা, আহমদ (২০১৩ : ৩৮)।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন